দোলযাত্রা বা হোলি হলো ভারতের হিন্দু ধর্মে একটি জনপ্রিয় ও তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব। এটি বসন্ত উৎসব এবং রঙের উৎসব নামেও পরিচিত। এই উৎসবের উৎপত্তি ভারতীয় উপমহাদেশে তাই সেখানে বেশী উদযাপিত হয় । এটি রাধা ও কৃষ্ণের শাশ্বত ও ঐশ্বরিক প্রেম উদযাপন এবং বসন্তের আগমন, অশুভ শক্তির বিনাশ শুভ শক্তির জয়ের নির্দেশিত করে।এই উৎসব জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবাই একত্রিত হয়ে,একে অপরকে রঙ মেখে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বার্তা দেয়।
দোলযাত্রার পৌরাণিক কাহিনী -:
(১) রাধা ও কৃষ্ণের শাশ্বত ও ঐশ্বরিক প্রেম -: দোলযাত্রা হলো রাধা ও কৃষ্ণের শাশ্বত ঐশ্বরিক প্রেম উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। পুরাণ অনুসারে শ্রী কৃষ্ণ তার বাল্যকালে গোকুলে রাধা ও গোপীদের সাথে রঙ খেলার মাধ্যমে বসন্তকে বরণ করেন এবং রাঙিয়ে তোলেন।এই প্রেম ও উল্লাসের কাহিনী পরবর্তী কালে দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব নামে পরিচিত হয়েছে।
(২) শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব ও গৌর পূর্ণিমা -: বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের জন্য এই দিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই দিনে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে দোল পূর্ণিমার দিন নবদ্বীপে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্ৰহণ করেন।তাই এটি গৌর পূর্ণিমা নামে পরিচিত এবং বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা এই দিনে বিশেষ আচার – অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করেন।
(৩) ভক্ত প্রহ্লাদ এবং হোলির গল্প -: হিন্দু পুরাণ মতে অসুর রাজা হিরণ্যকশিপু হোলিকা নামে এক রক্ষসীকে পাঠান, তার পুত্র প্রহ্লাদকে হত্যা করার জন্য কারণ প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণু ভক্ত। কিন্তু ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় হোলিকা পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং প্রহ্লাদ রক্ষা পায়।এই কারণে হোলির আগের দিন ” হোলিকা দহন” পালন করা হয়, যা অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির জয়ের প্রতীক।
দোলযাত্রা উদযাপন -:
(১) ধর্মীয় আচার ও পূজা -: দোল পূর্ণিমার রাতে রাধা ও কৃষ্ণের যুগলমূর্তি দোলায় সিংহাসনে প্রতিষ্ঠান করে, বিধি মতে পূজা,আবির ও ভোগ উৎসর্গ করা হয়। এবং গভীর রাতে হোলিকা দহন করা হয়।
বিভিন্ন পূজা মন্ডপে , মন্দিরে ও আশ্রমে হরিনাম সংকীর্তনের মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করা হয়।
(২) রঙ খেলা, উৎসবের মূল আকর্ষণ -: দোল উৎসবের সবচেয়ে বড় আকর্ষণীয় দিক হলো রঙ খেলা। এই দিনে আবির,গুলাল ও রঙিন জলের মাধ্যমে ছোট বড় সবাই একত্রিত হয়ে রঙ দেয়া,মাখা মাখি রাঙিয়ে তোলে।
(৩) বসন্ত উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান -: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে দোল উৎসবকে এক নতুন রূপ দিয়েছিলেন। এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বসন্তকে বরণ করা হয়। কবিগুরুর গান, নৃত্য ও আবৃত্তির মাধ্যমে এখানের উৎসব জনপ্রিয় হয়।
(৪) বিশেষ খাবার ও ভোগ প্রসাদ-: দোলযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বিশেষ খাবার ও প্রসাদ ভোগ।এই দিনে দধি,গুড়, সন্দেহ, রসগোল্লা,পায়েস,ক্ষীর এবং এক প্রকারের পানীয় ( দুধ,বাদাম,গোলাপজল ও মশলা দিয়ে তৈরী) খুবই আকর্ষণীয়।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে দোলযাত্রার বৈচিত্র্যময় উদযাপন -;
(১) বৃন্দাবন ও মথুরায় -: শ্রী কৃষ্ণের জন্মস্থান হওয়ার জন্য খুবই জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়। বিভিন্ন আচার ও অনুষ্ঠানে মাধ্যমে অনেক দিন ধরে পালিত হয়।
(২) পশ্চিমবঙ্গের দোলযাত্রা -: এখানে রাধাকৃষ্ণের প্রতিমা দোলায় বসিয়ে পূজা করার পর এই প্রতিমা সহ দোলা নিয়ে শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রার চলে রাধাকৃষ্ণের গান,নাচ ও আবির খেলা।
(৩) রাজস্থান ও গুজরাটের হোলি -: এই স্থানে ” রাজপুত হোলি” নামে এক বিশেষ ধরনের যুদ্ধাভ্যাস প্রর্দশনীর আয়োজন করা হয়,এই প্রর্দশনীতে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে তরোয়াল খেলা হয়।
দোলযাত্রার সামাজিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য -:
(১) সামাজিক সম্প্রীতি ও ঐক্য-: এই উৎসব জাতি, ধর্ম এবং বর্ন নির্বিশেষে সবাইকে একত্রিত করে। এবং একে অপরকে রঙ মাখামাখি করে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বার্তা দেয়। এই উৎসব আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে সব বিভেদ ভুলে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হতে। প্রকৃতি ও ঋতুর পরিবর্তনকে উদযাপন করতে। বসন্তের সূচনা এবং নতুন আশায় প্রতিক। রঙের মাধ্যমে জীবনের গ্লানি দূর করে এক নতুন উদ্দিপনার সৃষ্টি করে।