রামেশ্বরম মন্দিরের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও মাহাত্ম্য।

রামেশ্বরম মন্দির, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। এটি দ্বাদশ জ্যোতিলিঙ্গের মধ্যে একটি, এবং চারধামের মধ্যে অন্যতম একটি ধ্যাম। এটি শ্রী রামনাথ স্বামী মন্দির নামেও পরিচিত। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামেশ্বরম দ্বীপে অবস্থিত। তীর্থযাত্রীরা এখানে আসেন মোক্ষ লাভের জন্য। এটি ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শৈব তীর্থস্থান।

রামেশ্বরমের পৌরাণিক কাহিনী -: রামেশ্বরম মূলত হিন্দু ধর্মগ্ৰন্থ রামায়ণের সাথে গভীর ভাবে সম্পর্কিত। রামায়ণে উল্লেখ আছে,লঙ্কার রাজা রাবণকে পরাজিত করার পর শ্রী রামচন্দ্র,লক্ষণ, ও সীতা সহ বাড়ি ফেরার সময় এই স্থানে আসেন। রামচন্দ্র শিব পূজার ইচ্ছা প্রকাশ করেন কারণ ব্রহ্মাহত্যার পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যেহেতু রাবণ ছিলেন ব্রহ্মাণ । কথিত আছে দেবতাদের ইচ্ছা অনুযায়ী হনুমানকে কৈলাস পর্বত থেকে শিবলিঙ্গ আনতে পাঠানো হয়। কিন্তু হনুমানের ফিরে আসতে দেরী হওয়ায় জন্য মা সীতা বালুকাময় মাটি দিয়ে শিবলিঙ্গ তৈরী করেন।যা বর্তমানে রামলিঙ্গম নামে পরিচিত।পরে হনুমান কৈলাস পর্বত থেকে শিবলিঙ্গ নিয়ে ফিরে আসেন তাই এই মন্দিরের দুইটি শিবলিঙ্গের পূজা হয়।

রামেশ্বরম মন্দিরের স্থাপত্য ও গুরুত্ব -: রামেশ্বরমের প্রধান আকর্ষণ হলো বিশাল গর্ভগৃহ,দীর্ঘতম করিডোর এবং অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর জন্য বিখ্যাত। দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত।এই করিডোরের দৈর প্রায় ১,২০০ মিটার এটি বিশ্বের দীর্ঘতম মন্দির করিডোর গুলোর মধ্যে অন্যতম। করিডোরের স্তম্ভগুলির সুক্ষ্ম খোদাই এবং শিল্পকলা অত্যন্ত সুন্দর। মন্দিরে প্রবেশদ্বার অত্যন্ত সুসজ্জিত এবং ৩৮ মিটার উঁচু। এই মন্দিরের দুইটি শিবলিঙ্গ আছে। একটি রামেশ্বরম, অপরটি বিশ্বলিঙ্গম।

রামেশ্বরম মন্দিরের মাহাত্ম্য ও ধর্মীয় গুরুত্ব -:

(১) শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মিলনস্থল -: রামেশ্বরম মন্দির হিন্দু ধর্মের বিশেষ করে শৈব ও বৈষ্ণব উভয়ের জন্যই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র তীর্থস্থান।এটি একটি শৈব মন্দির হলেও এখানে ভগবান বিষ্ণুর ও পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই তীর্থক্ষেত্রটি শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মিলনস্থল এবং একত্রিত করে।

(২) রামেশ্বরম চার ধামের মধ্যে এটি একটি ধাম -: পুরাণ অনুসারে হিন্দু ধর্মে চারটি তীর্থক্ষেত্র দ্বারকা,বদ্রীনাথ,পুরী ও রামেশ্বরম চার ধাম নামে পরিচিত। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয় রামেশ্বরম মন্দিরটি পাপ মুক্তির পথ।

(৩) পবিত্র ২২ কুণ্ডুরে স্থান-: রামেশ্বরম মন্দিরের আশেপাশের ২২টি তীর্থকুণ্ড বা জলাধার আছে, যা অতি পবিত্র বলে প্রচলিত আছে। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে এই কুণ্ডের স্থান করিলে শরীর ও আত্মা শুদ্ধ হয় এবং পাপ মুক্তি হয়।

(৪) মৃত আত্মার মুক্তি -: রামেশ্বরমে বহু ভক্ত তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনার উদ্দেশ্য তর্পণ ও বিশেষ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেন। বিশ্বাস করা হয় যে এই স্থানে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্য তর্পণ করলে তারা মোক্ষলাভ করেন।

রামেশ্বরম ভৌগলিক অবস্থান ও সংযোগ -: রামেশ্বরম মন্দির ভারতের দক্ষিণ – পূর্ব উপকূলে, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এটি রামনাথপুরম জেলার অন্তর্গত। রামেশ্বরম দ্বীপটি মূলতঃ সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিত। এখানে জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র প্রকৃতির, এবং বছরের বেশিরভাগ সময়ই নাতিশীতোষ্ণ থাকে।
রামেশ্বরম সহজেই ট্রেন,বাস ও সড়ক পথে পৌঁছানো যায়। নিকটবর্তী বিমান বন্দর মাদুরাইতে অবস্থিত,যা প্রায় ১৭৫ কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে ট্যাক্সি বা বাসে সহজে পৌঁছানো যায় ।

রামেশ্বরমের পানবান সেতু -: পানবান সেতু ভারতের অতি প্রাচীন অন্যতম সমুদ্র সেতূ যা মূল ভূখণ্ডের রামেশ্বরমকে সংযুক্ত করেছে। এটি সমুদ্রের উপর নির্মিত রেলসেতু, এটি পর্যটকদের কাছে খুব আকর্ষণীয়।

ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য -: রামেশ্বরম শুধুমাত্র ধর্মীয় স্থান নয়, এখানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, যায় মধ্যে মহাশিবরাত্রি এবং রামনবমী অন্যতম। এছাড়া প্রতিদিন হাজার হাজার তীর্থযাত্রী এখানে এসে গঙ্গাসাগর ও অগ্নিতীর্থে স্থান করেন।

উপসংহার -: রামেশ্বরম মন্দির শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যশৈলী ভাবে ও এটি একটি বিস্ময়কর স্থান।শিবভক্ত ও বিষ্ণু ভক্তদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান।প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ভক্তরা এখানে মোক্ষলাভের জন্য আসেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top