মহাশিবরাত্রি হলো হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব, ভগবান শিবের উপাসনার দিন। শিবরাত্রি শব্দটি দুটি সংস্কৃত শব্দ ” শিব” এবং ” রাত্রি” থেকে এসেছে যার অর্থ শিবের রাত। শিবরাত্রি ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় এবং অতি প্রাচীন হিন্দু উৎসব, এই তিথিতে ভগবান শিবের পূজা উপলক্ষে উদযাপিত হয়, এবং শিবভক্তরা তাহার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এই শুভ দিনটি ফাল্গুন মাসে কৃষ্ণ চতুর্দশীতে পালন করা হয়। মহাশিবরাত্রি শুধুমাত্র একটি উৎসব তা নয়, এটি আধ্যাত্মিক সাধনার দিন।
মহাশিবরাত্রির পৌরাণিক কাহিনী -: শিবরাত্রির সঙ্গে অনেক পৌরাণিক কাহিনী আছে। মহাশিবরাত্রি উদযাপন মূলত তিনটি প্রধান কাহিনীর সাথে সম্পর্কিত।
(১) শিব-দেবী পার্বতীর বিবাহ -: শিব পুরাণ মতে ভগবান শিব ও দেবী পার্বতীর বিবাহ মহাশিবরাত্রির রাতে সম্পন্ন হয়েছিল। দেবী পার্বতী বহু তপস্যার পর এই দিনে তিনি শিবকে পতিরূপে পান। হিন্দুদের কাছে এই দিনটি শিব – দেবী পার্বতীর বিবাহের দিন হিসেবে পরিচিত।
(২) সমুদ্র মন্থনের কাহিনী -: দেবতারা এবং অসুরা মিলিতভাবে হয়ে সমুদ্র মন্থন করেছিলেন সেই সময় হলাহল নামক এক ভয়ংকর বিষ উঠেছিল,সেই বিষ পৃথিবীর ধ্বংস করতে পারত,তাই ভগবান শিব সেই বিষ পান করে তা নিজের গলায় ধারণ করেন। সেই বিষে তার গলা নীল হয়ে যায় সেই থেকে তিনি নীলকন্ঠ নামে পরিচিত। এই মহাশিবরাত্রির দিনে তিনি পৃথিবীর ধ্বংস হাত থেকে রক্ষা করেন তাই মহাশিবরাত্রির উদযাপন করা হয় সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও রক্ষার কামনা জন্য ।
(৩) শিবলিঙ্গ উৎপত্তি এবং ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর পূজা -: পৌরাণিক কাহিনী মতে এই মহাশিবরাত্রির দিনে শিবলিঙ্গের উৎপত্তি হয়, এবং এই দিনে প্রথম ব্রহ্মা ও বিষ্ণু শিবলিঙ্গ পূজা করেন।
মহাশিবরাত্রির উদযাপনে আচার – অনুষ্ঠান -: মহাশিবরাত্রির মূল আকর্ষণ হলো,সারা দিনব্যাপী উপবাস এবং রাত্রি জাগরণ।
(১) উপবাস -: মহাশিবরাত্রির দিন অর্থাৎ শিব- চতুর্দশী তিথিতে উপবাস পালন করা। উপবাসের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব ও অপরিসীম, এতে শরীর শুদ্ধ এবং একাগ্ৰ হতে সাহায্য করে।
(২) রাত্রি জাগরণ -: সারা রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে ভক্তরা শিবের মহিমা স্মরণ করেন এবং ভগবান শিবের নিকট আশির্বাদ প্রার্থনা করেন। বিশ্বের আছে এই রাত্রে তিনি ভক্তদের কামনা পূর্ণ করেন।
(৩) ভজন ও কীর্তন -: ভগবান শিবের মহিমা গেয়ে ভক্তরা দিনটি উদযাপন করেন। বিভিন্ন স্থানে সারারাত ভজন ও কীর্তনের আয়োজন হয়।
(৪) মহাশিবরাত্রি এবং যোগ সাধনা -: শাস্ত্রীয় মতে মহাশিবরাত্রির রাত ধ্যান ও প্রনায়ামের জন্য শুভ, এই সময় সাধনা করলে আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং শান্তি লাভ হয়। মহাশিবরাত্রির দিনে অনেক যোগী এবং সাধক ধ্যান ও যোগের মাধ্যমে ভগবান শিবের আরাধনা করেন।
মহাশিবরাত্রির পূজার ব্রতে নিয়ম ও মন্ত্র-:
ব্রতের উপকরণ-: গঙ্গামাটি বা শুদ্ধ মাটি,বিল্বপত্র, গঙ্গাজল,ফুল,দুগ্ধ,দধি,ঘৃত,মধু ,বাতাসা ও ফল।
ব্রতের নিয়ম-: শিবরাত্রির আগের দিন হবিষ্যান্ন বা নিরামিষ খাবার একবার খেতে হয়, রাত্রে বিছানায় না শুয়ে খড় বা কম্বলে উপর শুতে হয়। ব্রতের দিন উপবাস থেকে গঙ্গামাটি বা শুদ্ধমাটি দিয়ে চারটি শিবলিঙ্গ গড়ে চার প্রহরে একটি করে শিবলিঙ্গের পূজা করতে হয়। অর্থাৎ চারবার পূজা হবে, প্রতি প্রহরে একটি নতুন শিবলিঙ্গকে পূজা হবে।প্রতিষ্ঠিত শিব থাকলে তাতেই চার প্রহরে চারবার পূজা করতে হয়।ব্রতের দিন সারারাত্রি জাগরণ করে, পরদিন ব্রতকথা পাঠ অথবা ব্রতকথা শুনে, ব্রাহ্মন ভোজন করিয়ে ও সাধ্যমতো দক্ষিণা দিয়ে পারণ করতে হয়।
পারণ মন্ত্র -: ওঁ সংসারক্লেশদগ্ধস্য ব্রতেনানেন শঙ্কর।প্রসীদ সুমুখোনাথ জ্ঞানদৃষ্টি প্রদো ভব।। শিব পূজার ন্যায় সমস্ত ,স্নান মন্ত্র অর্ঘ্যদান মন্ত্র কেবলমাত্র পৃথক। প্রতি প্রহরের শিব পূজার শেষে গৌরী পূজা ও অষ্ঠমূর্তীর পূজা হয়।
প্রথম প্রহরে -: এই প্রহরে ধ্যান, প্রনাম,দুগ্ধ দিয়ে স্থান। স্নান মন্ত্র- ” ইদং স্থানীয়ং দুগ্ধং ওঁ হৌং ঈশানায় নমঃ।”
অর্ঘ্য নিবেদন মন্ত্র-ওঁ শিবরাত্রি ব্রতং দেব পূজাজপপরায়ণঃ।করোমি বিধিবদ্দত্তং গৃহাণ্যর্ঘ্যং মহেশ্বর।
দ্বিতীয় প্রহরে -: এই প্রহরে ধ্যান, প্রনাম,দধি দ্বারা স্নান,- স্নান মন্ত্র- ইদং স্নানীয়ং দধি ওঁ হৌং অঘোরায় নমঃ।
অর্ঘ্য নিবেদন মন্ত্র-: ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় সর্বপাপহরায় চ ।শিবরাত্রৌ দদামর্ঘ্যং প্রদীদ উমায় সহ ।
তৃতীয় প্রহরে -: এই প্রহরে ধ্যান, প্রনাম,ঘৃত দ্বারা স্নান। স্নান মন্ত্র- ইদং স্নানীয়ং ঘৃতং ওঁ হৌং বামদেবায় নমঃ।
অর্ঘ্য নিবেদন মন্ত্র- ওঁ দুঃখ দারিদ্র্য শোকেন দগ্ধোহহং পার্বতীপ্রিয়।শিবরাত্রৌ দদামর্ঘ্যং উমাকান্ত গৃহাণ মে ।
চতুর্থ প্রহরে -: ধ্যান, প্রনাম,মধু দ্বারা স্নান। স্নান মন্ত্র – ইদং স্থানীয়ং মধু ওঁ হৌং সদ্যোজাতায় নমঃ।
অর্ঘ্য নিবেদন মন্ত্র -: ওঁ ময়া কৃতান্যনেকানি পাপানি হর শঙ্করঃ।শিবরাত্রৌ দদামর্ঘ্যং উমাকান্ত গৃহাণ মে।
নিষিদ্ধ বাদ্য-: শিব পূজার নিষিদ্ধ বাদ্য করতাল।
কোন নিষিদ্ধ ফুল কেবলমাত্র শিবরাত্রিতে অর্পণ হয়-: কেতকী ফুল কেবলমাত্র শিবরাত্রিতে শিব পূজার ব্যবহার হয়। কেতকী মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ভগবান শিব অভিশাপ দেন যে কেতকী ফুলে কোনদিন শিব পূজা হবে না। কেতকীর অনেক অনুরোধে এই এক দিনের আশির্বাদ দেন।
মহাশিবরাত্রির তাৎপর্য -: যজ্ঞের মধ্যে যেমন অশ্বমেধ যজ্ঞ, তীর্থের মধ্যে যেমন গঙ্গা, তেমনি ব্রতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্রত হলো শিব চতুর্দশী ব্রত।এই ব্রত পালন করলে ধর্ম,অর্থ,কাম,মোক্ষ চতুর্বিধ ফল লাভ হয়।
উপসংহার -: মহাশিবরাত্রি হলো ভগবান শিবের পূজার দিন, ভক্তদের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার চেতনা এবং শুদ্ধির অনুভুতি নিয়ে আসে। এই পবিত্র পবিত্র দিনটি ধর্মীয়, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।