ভগবান শিবের ১৯ টি অবতার রূপের নাম। ও বিস্তারিত বিবরণ।

ভগবান শিব যিনি দেবতাদের আদি দেবাদিদেব মহাদেব, তিনি রুদ্র, তিনি নীলকন্ঠ তিনি আবার মৃত্যুঞ্জয় আরও অনেক রূপে অনেক নামে পরিচিত। দুষ্টের দমন সৃষ্টি ও ধর্মকে রক্ষার জন্য ভগবান শিব যুগে যুগে মানবজাতির কল্যানের জন্য বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন অবতার রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। প্রতিটি অবতার রূপে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাহার অসীম শক্তির বিভিন্ন দিককে প্রতিফলিত করেন।শিব পুরানের ভগবান শিবের ১৯টি অবতার রূপে উল্লেখ আছে।


১৯টি অবতার রূপের নাম -: (১) পিপলাদ অবতার, (২) নন্দী অবতার, (৩) বীরভদ্র অবতার, (৪) শরভ অবতার, (৫) ভৈরব অবতার, (৬) অশ্বত্থামা অবতার, (৭) কীরাত অবতার, (৮) দূর্বাসা অবতার, (৯) যোগীশ্বর অবতার, (১০) গৃহপতি অবতার, (১১) হনুমান অবতার, (১২) রুদ্র অবতার, (১৩) দূর্গা অবতার, (১৪) ভূঙ্গী অবতার, (১৫) গঙ্গাধর অবতার, (১৬) হরগৌরী অবতার, (১৭) চন্দ্রশেখর অবতার, (১৮) নীলকন্ঠ অবতার, (১৯) অবধূত অবতার।

( ১ ) পিপলাদ অবতার -: এই অবতারে তিনি ঋষি দধিচির ঘরে জন্ম গ্ৰহণ করেন। তিনি তার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে আবির্ভূত হন।শনিদেব তার পিতার মৃত্যুর কারণ জানতে পারে তিনি শনিদেবকে অভিশাপ দেন এবং পরে দেবতাদের অনুরোধে তাকে ক্ষমা করে দেন।শর্ত রাখেন যে শনি দেব ১৬ বছরের নীচে কাউকে বিরক্ত করবে না।

(২) নন্দী অবতার -: কৈলাশে নন্দী শিবের দাররক্ষক , তিনি শিবের বাহন ও ভক্ত এই নন্দী আবার শিবের অবতার রূপে পরিচিত। মহর্ষি শিলাদ নামে এক শাস্ত্রজ্ঞানী ঋষি জমিতে লাঙল দেওয়ার সময় জমি হতে নন্দীদেবের উৎপত্তি। পরবর্তী সময়ে নন্দীদেব ভগবান শিবের বাহন জন্য, ভগবান শিবের কাছে কঠোর তপস্যা করেন। ভগবান শিব নন্দীদেবের তপস্যার প্রসন্ন হয়ে তাকে নিজের বাহন হিসেবে এবং কৈলাশে দ্বারপাল হিসেবে নিয়োগ করেন। কথিত আছে ভগবান শিবের ভক্তরা নন্দীদেব বিগ্ৰহের কানে কানে নিজেদের মনস্কামনা জানাবেন আর সেই ভক্তদের কামনা তিনি সর্বদা পূর্ণ করবেন।নন্দীদেব ভগবান শিবের প্রতি ভক্তির প্রতীক।

(৩) বীরভদ্র অবতার -: দক্ষযজ্ঞে দেবী সতীর আত্মাহুতির পর, ভগবান শিব প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে তার মাথায় থাকে একটা চুল ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে তা থেকে জন্ম হয় বীরভদ্র। বীরভদ্র যজ্ঞ ধ্বংস করেন এবং দক্ষ রাজার মাথা কেটে ফেলেন।এই অবতার ভগবান শিবের ক্রোধের প্রতীক।

(৪) শরভ অবতার -: ভগবান শিবের একটি অপূর্ব অবতারের নাম হলো শরভেশ্বর বা শরভ অবতার। ভগবান বিষ্ণু শ্রী নৃসিংহদেব অবতার রূপে অত্যাচারী রাজা হিরন্যকশিপুরকে সংহার করেন। এরপর নৃসিংহ দেবের ক্রোধ প্রশমিত হচ্ছিল না,এর ফলে ত্রিলোকে প্রলয় নেমে আসার সম্ভাবনা দেখা দেয়। সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য ভগবান শিব – মনুষ্য,সিংহ এবং পাখির সংমিশ্রণে শরভ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ভগবান শিবের শরভ রূপ হলো অষ্ঠপদ বিশেষ কৃষ্ণবর্ণ, বড়ো নাক ,বড় নোখ এবং একটি বড় লেজ। ভগবান শিব শরভ অবতারে নৃসিংহ দেবের ক্রোধ প্রশমিত করে সৃষ্টিকে রক্ষা করেন।এই অবতার শিবের শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতীক।

(৫) ভৈরব অবতার -: ভগবান শিবের ভয়ঙ্কর রূপ হলো ভৈরব অবতার।আদিতে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার পাঁচটি মাথা ছিলো। চারটি মাথা বেদের জ্ঞান সম্পন্ন আর পঞ্চম মস্তক ছিলো কামাবৃত।এদিকে ভগবান শিব পঞ্চমাথার অধিকারী তাই তিনি পঞ্চানন। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা অহংকার করেন ,তিনি বলেন তাহার গুরুত্ব ভগবান শিবের চেয়ে অনেক বেশি। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার অহংকার ভাঙতে ভগবান শিব, ভৈরব অবতার রূপে ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক তথা কামাবৃত মস্তকটি কেটে ফেলেন এবং ব্রহ্মার অহংকার চুন্ন করেন। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমাপ্রার্থী হন। ব্রহ্মা হত্যার পাপ মোচনের জন্য দেবাদিদেব মহাদেব দীর্ঘ সময় ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় কাটান এই ভ্রাম্যমাণ শিব রূপ হলো ভৈরব বা কাল ভৈরব। ভৈরব অবতার ভগবান শিবের শক্তি ও ন্যায় বিচারের প্রতীক।

(৬) অশ্বত্থামা অবতার -: অশ্বত্থামা, মহাভারতের একজন অন্যতম প্রধান চরিত্র। ভগবান শিবের অবতার হিসেবে পরিচিত। তিনি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মহাভারতের অশ্বত্থামা হলেন মহাপরক্রমশালী বীর জন্মের সময় অশ্বের মতো শব্দ করে কেঁদে ওঠেন বলে তাহার নাম অশ্বত্থামা হয়েছিল।জন্ম থেকে তহার মাথায় এক মহামূল্যবান মনি থাকায় তিনি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি ও যন্ত্রনাকে জয় করতে পারতেন। তিনি মহাবীর হলেও ব্যাক্ত হিসেবে মহাপাপীষ্ঠ,পাষণ্ড, নীতি – নৈতিকর্তা ও বিবেক বর্জিত এক ধরাধাম। তিনি দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে রাতের অন্ধকারে অসংখ্য পাণ্ডব বীরদের হত্যা করেছে।এই কুকর্মের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার মাথায় মনি কেড়ে নিয়ে অভিশাপ দেন। ভগবান শিব অশ্বত্থামা অবতারে পাপ কর্মের মধ্যে দিয়ে মানুষকে দেখিয়েছেন হিংসা,পাপ, লোভ,কুসঙ্গের প্রভাবে মানুষের কি পরিনতি হয় এবং তার ফল ও ভোগ করতে হয়।

(৭) কীরাত অবতার -: এই অবতারে কাহিনী মহাভারতের বর্ণিত আছে। পাণ্ডবরা বনবাসে সময় অর্জুন ভগবান শিবের ত্যপসা করেন,পশুপাতস্ত্র অস্ত লাভের জন্য। ধ্যান রত অবস্থায় অর্জন দেখে একটা বড় শূকর, তার দিকে তেড়ে আসছে তখনই অর্জুন ধনুক নিয়ে শূকরের দিকে নিক্ষেপ করেন, তাকিয়ে দেখলো শূকরের অদূরে বনের সর্দার ধনুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কীরিত সর্দার বলে শূকরটি আমি মেরেছি আর অর্জুন দাবি করেন আমি মেরেছি।এই নিয়ে দুই জনের মধ্যে তুমুল সংগ্রাম বাঁধে । অবশেষে কীরিত রূপী ভগবান শিব নিজ রূপ ধারণ করিয়া অর্জুনকে পশুপাতস্ত্র অস্ত্র প্রদান করেন। ভগবান শিব বলেন আমি তোমাকে পরীক্ষা করলাম, এই অস্ত্র সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিত নয় । ভগবান শিবের এই রূপটি কীরিত বা কীরিতিশ্বর নামে খ্যাত।

(৮) দূর্বাস অবতার -: দুর্বাসা শব্দের অর্থ যাঁর সাথে বাস করা যায় না। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ মতে একবার ব্রহ্মা ও শিবের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘাতে ভগবান শিব এতটাই ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠেন, দেবতারা পর্যন্ত ভয়ে পালাতে আরম্ভ করেন। পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে দেবী পার্বতী ভগবান শিবকে পরিত্যাগ করতে চাইলেন। তখন ভগবান শিব তার সেই প্রবল ক্রোধাগ্নি অত্রি মুনির স্ত্রী অনুসূয়ার গর্ভে স্থাপিত করেন। ভগবান শিবের এই ক্রোধাগ্নির থেকে জন্ম হয় ঋষি দুর্বাসার। ভগবান শিবের ক্রোধাগ্নির থেকে ঋষি দুর্বাসার জন্ম তাই তিনি অল্পতেই ক্রুদ্ধ হন।এই কারণে ঋষি দুর্বাসাকে শিবের অবতার বলা হয়।এই অবতারে ভগবান শিব মানুষকে ক্রোধ প্রশমিত করার শিক্ষা দেন কারণ ক্রোধের পরিনাম ভয়ঙ্কর হয়।

(৯) যোগীশ্ব অবতার -: এই অবতারে ভগবান শিব একজন রোগীর রূপ ধারণ করেন এবং যোগ সাধনা করেন।যোগ সাধনার গুনাগুন প্রকাশ করেন।এই অবতার শিবের জ্ঞান ও ধ্যানের চর্চা।

(১০) গৃহপতি অবতার -: পূর্বাকালে নর্মদা নদীর তীরে বিশ্বনাথ ও শুচীস্মতি নামে নিঃসন্তানা পরম শিবভক্ত দম্পতি বাস করতেন।তারা সন্তান লাভের জন্য বারানসীতে গিয়ে বিশ্বেশ্বর এর কাছে কঠোর তপস্যা করেন, অবশেষে পুত্র সন্তান লাভ করেন।নাম রাখেন গৃহপতি।নারদ মুনি গৃহপতিকে দেখে বললেন এই বালকের আয়ু ১২ বছর। এই কথা শুনে বাবা ও মা খুব ভেঙে পরেন। গৃহপতি তার মা বাবাকে বলেন,সকল দূর্ভাগ্যকে খণ্ডন করতে পারেন ভগবান শিব।তাই আমিও সেই দেবাদিদেবকে সস্তষ্ট করে আপনাদের দুঃখ দূর করবোই। এরপর গৃহপতি গঙ্গা তীরে মাটি দিয়ে শিবলিঙ্গ তৈরী করে ,তপস্যা করে শিবের কৃপায় দুর্ভাগ্য দূর করে ছিলেন। ভগবান শিব ভক্তের আকুল আবেদনে গৃহপতি অবতার রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বর্তমানে এটি অগ্নিশ্বর শিবলিঙ্গ নামে পরিচিত।

(১১) হনুমান অবতার -: এই অবতারে তিনি হনুমানের রূপ ধারণ করে আসেন। তিনি যেমন শক্তিশালী তেমনি ভক্তি ও ভক্ত ছিলেন। তিনি শ্রী রামচন্দ্রের ভক্ত ও সহায়ক ছিলেন।এই অবতার শিবের ভক্তি ও সেবার প্রতীক।

(১২) রুদ্র অবতার -: ভগবান শিব রুদ্র রূপ ধারণ করেন অসুরদের বধ করার জন্য।এই অবতারে শক্তিশালী ত্রিপুরাসুরকে বধ করেন।এই অবতার ভগবান শিবের শক্তি ও ন্যায় বিচারের প্রতীক।

(১৩) দূর্গা অবতার -: মহিষাসুরের অত্যাচারে দেবতারা ক্ষমতা ও সিংহাসন হারিয়ে ভগবান শিবের শরনাপন্ন হন। সেই সময় ভগবান শিব মহিষাসুর মর্দিনী অবতার রূপে আবির্ভূত হয়ে মহিষাসুরকে বধ করেন। এই অবতারে ভগবান শিবের শক্তি ও সাহসের প্রতীক।

(১৪)ভূঙ্গী অবতার -: এই অবতারে ভগবান শিব ভূঙ্গী ঋষির রূপ ধারণ করে শিব ও দেবী পার্বতীর মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন। আবার ভূঙ্গী হলো শিবের সহায়ক।এই অবতারে তার জ্ঞান ও বিচারের প্রতীক।

(১৫) গঙ্গাধর অবতার -: এই অবতারে ভগবান শিব গঙ্গাকে তার জটায় ধারণ করে পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন এবং গঙ্গাকে নির্দিষ্ট পথে পৃথিবীতে প্রবাহিত করেন।এই অবতার শিবের করুনা ও দানশীলতার প্রতীক।

(১৬)হরগৌরী অবতার -: হরগৌরী অবতারে শিব ও পার্বতী একত্রে আবির্ভূত হন। এই অবতারে শিব ও শক্তির মিলনকে প্রতিফলিত করে।এই অবতারে শিবের প্রেম ও ঐক্যের প্রতীক।

(১৭) চন্দ্রশেখর অবতার -: এই অবতারে ভগবান শিব চন্দ্রকে নিজের মস্তকে ধারণ করেন। এই অবতার শিবের শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতীক।

(১৮) নীলকন্ঠ অবতার -: সমুদ্র মন্থনের সময় হলাহল বিষ পান করেন এবং নীলকন্ঠ অবতার হয়।এই অবতার শিবের ত্যাগ ও সাহসের প্রতীক।

(১৯) অবধূত অবতার -: বলা হয় কারও প্রতি ভগবান রুষ্ট হলে সেই ব্যক্তিকে রক্ষা করতে পারেন তাঁর গুরু কিন্তু কোন ব্যক্তির প্রতি যদি তাঁর গুরু রুষ্ট হন তাহলে ভগবান ও রক্ষা করতে পারেন না। ভগবান শিব এই শিক্ষা প্রদান করার জন্য অবধূত অবতার রূপ ধারণ করেছিলেন।একদা দেবরাজ ইন্দ্র মোহবশে দেবগুরু বৃহস্পতিকে অপমান করেন।এর কিছু কাল পর দেবরাজ ইন্দ্র কৈলাশে যাত্রা শুরু করেছিলেন। ভোলানাথ শিবের সাথে সাক্ষাৎকার করতে। ইন্দ্রদেব দেখেন পথের মধ্যে পথ আটকে শুয়ে আছে এক পাগল সন্যাসী তথা অবধূত। দেবরাজ ইন্দ্র কড়া ভাষায় তাকে পথ ছাড়তে বললেন। অবধূত শুনলেন না। অবধূত পথ না ছাড়ায় ইন্দ্রদেব বজ্রস্ত্র দিয়ে অবধূতকে আঘাত করতে উদ্যত হলেন।আর ঠিক সেই সময় অবধূত রূপ ত্যাগ করে ভগবান শিব নিজের রূপ ধারণ করে, তৃতীয় নয়ন উন্মীলিত করে সেই নয়নের অগ্নি দ্বারা দেবরাজ ইন্দ্রকে ভস্মীভূত করতে উদ্যত হলেন। সেই সময় দেবগুরু বৃহস্পতি ছুটে এসে দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে ইন্দ্রের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা চাইলেন ,এবং ইন্দ্রদেবকে রক্ষা করেন ।গুরুর আদেশ পালন করার জন্য ভগবান শিব ইন্দ্রকে ক্ষমা করে দিলেন। দেবগুরু বৃহস্পতি হলেন সকল দেবতার গুরু।

প্রতিটি শিবের অবতার অসীম শক্তি ও করুনার প্রতিফলন। মানবজাতির কল্যানের জন্য শিবের অবদানকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top